ঘড়িতে রাত ৮ টা ৫ মিনিট। অনলাইনে একটি ক্লাস করার জন্য জুম এপ ইন্সটল দিতে হবে, ফোনের র্যাম কম হওয়ায় বেশি এপ একসাথে ফোনে রাখা যায় না। জুম এপটির সাইজ বড় হওয়ায় একবার ব্যবহার করে আনইন্সটল করে দিতে হয়।
ওইবার আর মনে ছিল না ইন্সটল দিয়ে গ্রামে আসার কথা। গ্রামে আসার পর রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইন্সটল দেওয়ার জন্য প্লে স্টোরে গেলাম। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর ডাউনলোড হওয়া শুরু করলো। আর যে ধীরগতিতে ডাউনলোড হচ্ছিল মনে হচ্ছিল যে ক্লাস শেষ হয়ে যাবে অথচ এপ ইন্সটল হওয়া শেষ হবে না, ক্লাস শেষে একা একা ক্লাস করতে হবে। এত গেল রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারের কথা।
যদি ঘরে বসে ইন্টারনেট ইউজের কথা বলি তাহলে আপনাদের বোধগম্য হবে কি পরিমাণ বাজে অবস্থায় আছি আমরা যারা গ্রামে বসবাস করি। বাড়িতে আসার পর আমার সকল ফ্রেন্ড সহ আত্মীয়স্বজনদের অভিযোগ আমি ফোন বন্ধ করে রাখি। কিন্তু আমার এই সমস্যা আর দুঃখের কথা বলি কাকে? ঘরে বসে ফোনে কথা পর্যন্ত বলা যায় না। সবসময় স্ক্রিনে ইমার্জেন্সি কল প্রদর্শন করে অর্থাৎ কল আসা-যাওয়া দুইটাই বন্ধ।
আমরা বাস করি যেন পাহার-বন-জঙ্গলে ঘেরা নেটওয়ার্ক বিহীন এক দূর্গম এলাকায়। এখন আসি মূল কথায়, এই যে আমাদের এত এত উন্নয়ন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পাঠিয়েছি, 4G যোগে বসবাস করছি, কিছুদিন পরেই নাকি আমরা 5G যোগে প্রবেশ করবো, এতে আমাদের গ্রামের মানুষদের ইন্টারনেট সুবিধার কতটুকু উন্নয়ন ঘটেছে তা এখন ভেবে দেখার বিষয়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, এমনকি উচ্চ-মাধ্যমিকের লাখ লাখ শিক্ষার্থী গ্রামে বসবাস করে। তাদেরকে ইন্টারনেটের আওতায় না এনে শিক্ষার মান উন্নয়নের কথা চিন্তা করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে “উলু বনে মুক্ত ছড়ানোর” মত। করোনা ভাইরাসের এই সময়ে সবাই তা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে।
শিক্ষার্থীদেরকে ইন্টারনেটের আওতায় এনে পাঠ কার্যক্রম চালিয়ে নেবার অনেক চেষ্টায় করেছে বর্তমান সরকার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই চেষ্টা কি ফলপ্রসূ হয়েছে? কত ভাগ শিক্ষার্থী সংসদ টেলিভিশন দেখে পড়াশোনার সংস্পর্শে থাকতে পেরেছে? আমার দু’বোন মাধ্যমিকে পড়ে। ভাইরাসের প্রায় দেড় বছর সময়টা পুরো দস্তর ঘরে বসে আছে। স্কুল বন্ধ, পড়াশোনার কোন সুযোগ নেই। আমি দূরে থেকে তাদের দিকনির্দেশনা দিবো তারও কোন সুযোগ নেই। ইউটিউব দেখে কিছু শিখবে তারও কোন ব্যবস্থা নেই। এইরকম হাজারো শিক্ষার্থী শুধু করোনাকালীন নয়, সর্বদা তারা উন্নত শিক্ষার সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ শহরের কোন ৬-৭ পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে যখন পড়াতে যাই তখন একজন গ্রামের শিক্ষার্থীর সাথে পার্থক্যটা বুঝতে পারি। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা বলি তবে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। এই দুর্যোগময় সময়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই তাদের গ্রামের শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে অনলাইন পরীক্ষা বাস্তবায়ন করতে পারে নাই, যদিওবা খুব স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে অনলাইন ক্লাসগুলো অব্যাহত রেখেছিল। যদি গ্রামের শিক্ষার্থীরা শহরের শিক্ষার্থীদের মত শতভাগ ইন্টারনেট সুবিধা পেত তবে আজকে আমাদের দেশে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটাই ফলপ্রসূ হত। শিক্ষার্থীরা যথাসময়ে ক্লাস করতে পারত, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারত, ইউটিউব দেখে অনেক পড়া তৈরি করতে পারত।
কিন্তু তার সুযোগ কোথায়? যেখানে ঘরে বসে মুঠোফোনে কথা বলাই স্বপ্নের মত সেখানে ইন্টারনেট ব্যবহার বিলাসিতা ছাড়া কিছুই না। কিছুদিন পূর্বের জরিপে দেখানো হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ধীরগতির ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে বাংলাদেশ। যার দরুন আমার মত বহু বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর কাছে গ্রামে বসবাস এক বিভীষিকায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু এর কি কোন সমাধাম নেই? রয়েছে সমাধান, ভাল সমাধান রয়েছে।
আচ্ছা বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের যতগুলো খুঁটি বা টাওয়ার শহর বা পৌরসভা পর্যায়ে রয়েছে তার ১ শতাংশোও কি গ্রামে রয়েছে? আমি যে গ্রামে বাস করি সেখানে শতশত প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে। অথচ প্রায় ৪-৫ কিলোমিটারের কাছাকাছি কোন মোবাইল অপারেটরের টাওয়ার বা খুঁটি নেই। ইন্টারনেটের জন্যে আমাদেরকে নির্ভর করতে হয় পৌরসভার টাওয়ারগুলার উপর। ওয়াইফাই সুবিধার কথা ত স্বপ্নেও ভাবার সুযোগ নেই। কেন এই নাজেহাল অবস্থা? গ্রামের মানুষজন কি ইন্টারনেট ব্যবহার তথা ইন্টারনেটের সুবিধা সম্পর্কে অবহিত না? এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে প্রতি হাজারে গ্রাম থেকে শহরে আসত ২৮ দশমিক ২ জন। ২০১৮ সালে সেই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৬ জনে। অর্থাৎ চার বছরে গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী মানুষের সংখ্যা প্রতি হাজারে বেড়েছে ২ দশমিক ৪ জন। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশের পুরো জায়গাটা বসবাসের যোগ্য করে তুলতে না পারলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। শহরমুখী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে কৃষিজ দ্রব্যাদি উৎপাদন ব্যহত হবে, খাদ্য সংকটে পরবে সমস্ত জাতি, কমবে জিডিপি। অপরদিকে ইন্টারনেট সুবিধা ভাল থাকলে কৃষক নতুন নতুন ফসল এবং সার সম্পর্কে অবহিত হবে, অধিক উৎপাদনমুখী হবে আমাদের কৃষি। এতে খাদ্য সংকট মিটানো অনেকটাই সহজতর হবে বলে আশা করা যায়। আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা বলি। দেশে ইন্টারনেটের এহেন পরিস্থিতি বজায় রেখে শিক্ষার মান উন্নয়ন না করে বিপ্লবের কথা চিন্তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে। বিদ্যুৎ সুবিধার অভাবে কিভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে গ্রাম তথা দেশ, তা না হয় অন্য একদিন আলোচনা করব। জাকারিয়া হোসাইন জয়, শিক্ষার্থী,ফার্মেসি বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।